সাবর্ণ সংগ্রহশালার চতুর্দশ আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসব
কলকাতার ইতিহাসের সাথে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের যোগসূত্রের ঐতিহাসিকতা এবং নিজস্ব সংস্কৃতির ঔজ্জ্বল্যকে তুলে ধরার প্রয়াসে বড়িশার বড়বাড়িতে গড়ে উঠেছে একটি দুর্লভ সংগ্রহশালা। ইতিহাস ও নান্দনিকতার মিশেলে ঐতিহ্যের এই বহিঃপ্রকাশ যেমন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারকে অনন্য পরিচয়ে উপস্থাপন করে চলেছে, একইসাথে তাদের নিয়মিত বাৎসরিক আয়োজন “সাবর্ণ সংগ্রহশালার ইতিহাস ও পুরাকীর্তি বিষয়ক প্রদর্শনী” শুধু কলকাতাবাসীর মনেই নয়, বরং আগ্রহী সকল বাঙালীদের মনেই বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। কারণ এই সংগ্রহশালা যেমন ধারণ করছে বাঙালী ঐতিহ্যের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্মারক, পাশাপাশি লালন করে চলেছে বিভিন্ন কৃষ্টি ও চিরায়ত বাঙালীয়ানাকে। অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় সাবর্ণ সংগ্রহশালার ইতিহাস ও পুরাকীর্তি বিষয়ক প্রদর্শনী’র ১৪তম আসরটি ০৩-০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পযর্ন্ত চলে। এ বছরের থিম কান্ট্রি হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল - জাপান। প্রতি বছরই ব্যতিক্রমী নানা আয়োজন ও উপস্থাপনায় এই প্রদর্শনীটি সময়ের সাথে সাথে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।
১৪তম প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বিশ্ব বিখ্যাত জাদুকর পি সি সরকার জুনিয়র। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, অরোরা ফিল্মসের অঞ্জন বসু, ফ্রান্সের ভাইস কনসাল মোনামি কাটো, ফ্রান্সের জোসেফাইন গ্রোজেনেক, জাদুকর পিসি সরকার জুনিয়ারের স্ত্রী সোনালি সরকার, অভিনেতা নীলাদ্রি লাহিড়ী। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রাধারমণ রায়।
এই আয়োজনে এবারে যা যা ছিল -
১। বাংলা সিনেমার ১০০ বছর। ছিল এন্টনি ফিরিঙ্গী, মেবার সিংহাশন, কবি ও ডাঃ ডাম্ব এর মূল স্ক্রিপ্ট। ছিল সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের ঠাকুমা প্রতিভা রায় চৌধুরীর চার দশক ধরে সংগ্রহ করা প্রায় ১২০ টি দুর্লভ সিনেমার বুকলেট। আরও ছিল হীরালাল সেন, প্রণব রায়, অমর চৌধুরী এবং সত্য চৌধুরীর ওপর বিশেষ গ্যালারি। আরও থাকছে সিনেমার পোস্টার, বই, পুরাতন ম্যাগাজিন, রিল, স্পুল সহ অনেক কিছু। ১০০ বছর আগের নির্বাক চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা ক্যামেরাটি দেখে শরীরে শিহরণ লাগতে বাধ্য, যদিও স্পর্শ করার অনুমতি নেই, তবু চোখ দিয়েই স্বাদ নিতে হয়। ক্যামেরাটি বিখ্যাত সেই অরোরা ফ্লিমসের।
২। ৪০০ বছরের সিঁদূর কৌটোর সংগ্রহ। প্রদর্শন করা হয় সোনা, রূপো, হাতির দাঁত, পাথর ও কাঠের নানান ধরনের সিঁদূর কৌটো।
৩। মহাত্মা গান্ধীর ১৫০ বছর। সারা পৃথিবী থেকে প্রকাশিত গান্ধীর উপর ডাকটিকিট। ছিল ৩১ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালের আনন্দবাজার ও অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর খবর। আরও ছিল ১৯৩১ সালে রেকর্ডে মহাত্মা গান্ধীর মূল স্বাক্ষর সহ অনেক কিছুই।
৪। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের Retrospective এবং তাঁর ব্যবহৃত জিনিষপত্র।
৫। সাবর্ণ পরিবারের সদস্যদের তৈরি কোলাজ চিত্র।
৬। জাপান কনসুলেট জেনারাল এর সহযোগিতায় জাপান সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য।
৭। পরিবারের ঐতিহ্যপূর্ণ হাতে লেখা পত্রিকা সপ্তর্ষির ত্রিংশততম সংখ্যার উদ্বোধন।
৮। শচীন তেনডুলকরকে নিয়ে বিশেষ গ্যালারিতে ছিল প্রথম শতরানের তারিখের একই নম্বর মেলানো দশ টাকার ১০০টি নোট সহ হেরিটেজ ওয়াক, কুইজ, প্রণব রায় দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান ও ছদ্মবেশ প্রযোজিত কলিকথা নাটক।
৯। কলকাতার প্রথম ইট (১৬০৮ সালের), শিবলিঙ্গের আকারের ইট (১৭১০ সালের)-সহ আরও অনেক কিছুই।
সতীনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, এই পরিবারের সঙ্গে কলকাতার ইতিহাস ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। কলকাতার প্রকৃত ইতিহাস জানা যায় এঁদের সংস্পর্শে এলে।
অরোরা ফিল্মসের অঞ্জনবাবু বলেন, এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতীয় সৈনিকদের বিনোদনের জন্য ছবি হয়েছিল যে ক্যামেরা দিয়ে সেই ক্যামেরা এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। এই উদ্যোগ খুবই সুন্দর।
অভিনেতা নীলাদ্রিবাবু বলেন, গোটাটাই ইতিহাস। বাঙালিদের কাছে চলচ্চিত্রের ১০০ বছরের ইতিহাস তুলে ধরার প্রচেষ্টার কোনো তুলনা হয় না।
জাদুকর পি সি সরকার বলেন, শিকড় খুঁজতে এখানে আসা। বিদেশি কোনো কিছুর থেকে নিজের সংস্কৃতি ঐতিহ্য অনেক প্রিয়। সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হবে। সেই প্রয়াস করছে সাবর্ণ সংগ্রহশালা। এটি খুবই উত্তম।
জাপানের ভাইস কনসাল মনামি কাটো বলেন, দু’ দেশের সম্পর্ক খুবই মধুর। সেটাই প্রকাশ পেয়েছে সাবর্ণ পরিবারের এই প্রদর্শনীতে।
সাবর্ণ পরিবারের সদস্য দেবর্ষি রায়চৌধুরি জানান, হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস বা সময়ের কোলে লুকিয়ে থাকা অনেক অজানা তথ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা তাঁদের মূল উদ্দেশ্য। মানুষের শিকড়ের সন্ধান তাকে চিনতে শেখায়, ইতিহাসকে জানায়। সেই ইতিহাসকে মানুষের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়েই এই আয়োজন। মানুষ এসে যখন এই শিকড়ের খোঁজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবেন সেটিই হবে এই প্রদর্শনীর সার্থকতা। তাই সবাই আসুন দেখুন আর নিজেদের অতীতটাকে জানুন।