সূর্যের বুকে শুক্রের চলন
- ১৪:৩৩
- কার্যক্রম প্রতিবেদন
- ২৬০৮
গত ৬ জুন, ২০১২ হয়ে গেল ভেনাস ট্রানজিট। বিজ্ঞান সংগঠন ডিসকাশন প্রজেক্ট এবং সহযোগী সংগঠন দেশব্যাপি আয়োজন করে এ মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষনের নানা আয়োজন। ডিসকাশন প্রজেক্ট -এর সমন্বয়ে গড়ে তোলা এই কমিটির নাম ‘মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ কমিটি : মহাবৃত্ত’। আঞ্চলিক সহযোগী হিসেবে ছিল কসমিক কালচার, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগার, ব্রাহ্মণ বাড়িয়ার সপ্তর্ষি বিজ্ঞান ক্লাব, কুষ্টিয়ার বিজ্ঞান সংগঠন ইয়ুথ সায়েন্স গ্রুপ, খুলনা ডিসকাশন প্রজেক্ট, পাবনার বন্ধুসংঘ এবং বিষয়ভিত্তিক সংগঠন হিসেবে ছিল বাংলাদেশ নেচার স্টাডি অ্যান্ড কনসারভেশন ইউনিয়ন। এ ছাড়াও কর্মশালায় সহযোগিতা করেছিল ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। ঢাকায় মূল পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প তৈরিতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল ঢাকা ইমপেরিয়াল কলেজ। ২৬ জুন, ২০১২ তারিখের দৈনিক সংবাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাতায় বিজ্ঞান কর্মী জাহাঙ্গীর সুর-এর লেখা অবলম্বনে ৫ জুন রাত থেকে সামগ্রিক প্রস্তুতি এবং পরবর্তী কার্যক্রমের খবর নিয়ে এই প্রতিবেদনটি।
ততক্ষণে রাত ভারী হয়ে গেছে অনেকখানি। অনেক উপরে তারা ভরা আকাশ। কিন্তু মাথার ঠিক উপরেই রাস্তার কৃত্রিম বাতি। শহুরে চোখে তাই রাতের তেমন কোন আবেদন থাকে না। সেদিনও ছিল না। সেদিন মানে ৫ জুন। রাত দশটা পেরিয়ে গেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গেট থেকে দ্রুত গতিতে দু’জন বেরুলেন। হন্তদন্ত হয়ে দিলেন দৌড়। রাস্তার ঠিক ওপারে আরেকজন বসে আছেন মোটরবাইকের ক্লাচ চেপে। ওই চালকের কাছে গিয়ে একটা ব্যাগ দিয়ে আসিফ বললেন, ‘যেভাবেই হোক রাতেই ডেন্টিস্ট জেনিথের কাছে এই চশমাগুলো পৌঁছে দিবেন, প্লিজ।’ চশমা? দাঁতের ডাক্তারের কাছে চশমা চালান? প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। এই ফাঁকে আসিফ আবার দৌড় দিয়ে ফিরছেন টিচার্স ট্রেণিং কলেজের ভেতর। সেকেন্ডে তিনি বড়জোর ৩ থেকে ৫ মিটার যেতে পারেন। অথচ বিজ্ঞান বক্তা আসিফ নিশ্চয়ই জানেন, আকাশে শুকতারাটা এই এক সেকেন্ডে ৩৫ কিলোমিটার গতিতে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে আসছে। এই হিসেবে ভোর চারটা ১০ মিনিটে সূর্যের সামনে চলে আসবে ‘ছোট’ গ্রহটা। যদি সূর্যে তখন চোখ রাখা যায়, দেখব কালো একটি বিন্দু। ঠিক যেন দুধসাদা তরুণীর গালে থাকা কালো এক তিল! বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে আরেকটু আশ্চর্য হব- মহাজাগতিক ওই তিলটি একটু একটু করে ‘হেঁটে’ যাচ্ছে সূর্যের শরীর বেয়ে! এ এক বিরল মহাজাগতিক দৃশ্য। সকাল প্রায় ১১টা পর্যন্ত সূর্যের সামনে দিয়ে এভাবেই হেঁটে পাড় হয়ে যাবে আমাদের চাঁদের চেয়েও ছোট ওই গ্রহটা। কিন্তু খালি চোখে তো সূর্যে তাকানো যায় না। তাই দরকার চশমা। একটু খোলসা করে বললে সৌরচশমা! নারায়ণগঞ্জে জেনিথের কাছে আসিফের পাঠানো ওই চশমাগুলো ছিল সৌরচশমেই। সাংস্কৃতিক জোট আর ডিসকাশন প্রজেক্ট মিলে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে বরফ কল ঘাটে উৎসুক মহাকাশ-দর্শকদের জন্য পাঠানো হয়েছিল চশমাগুলো। কিন্তু টিচার্স ট্রেইনিং কলেজে কি চশমা বানানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়? না, তা নয়। ওখানে, অডিটরিয়ামে বিকেলে একটা কর্মশালার আয়োজন করেছিল ‘মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ কমিটি : মহাবৃত্ত’। এরপর সদয় কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় বিজ্ঞানকর্মীরা অডিটরিয়ামে বসেই চশমা বানাতে থাকেন। যোয়েল কর্মকার স্টেপলারের পিন দিয়ে ১৪ নম্বর ওয়েলডিং গ্লাস গাঁথছেন নকশা করা কাগজের চশমায়। জাহাঙ্গীর সুর চশমার ছাঁচের বাইরে কাগজের অতিরিক্ত অংশ ছেটে ফেলছেন। আসিফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঁজ করে দিচ্ছেন চশমাগুলো। কিছুক্ষণ আগে এই দলে আরও ছিলেন শাহাবুদ্দীন সামি, অরণ্য আর সিরাজুম মনিরা ইরিনা। আসিফের ছেলে অরণ্য। সবার সঙ্গে চশমা বানানোয় মেতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল সেও। ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ইরিনা। এই শুক্রচলনকে কেন্দ্র করে তার ভেতর তৈরি হয়েছে অন্যরকম অনুভূতি। ‘জ্যোর্তিবিজ্ঞানী’ বলে ডাক দিয়ে সাড়া মিলল, ‘না না, ঠিক তা নয়। তবে বলতে পারেন, রেডিও সায়েন্টিস্ট।’ ক’দিন আগে তিনি রেডিও টেলিস্কোপ তৈরির প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন নাসার সহযোগিতায়। তো, ইরিনা তিন দিন ধরে রামপুরা-বাড্ডার যে বিশাল ফাঁকা মাঠ, ওখানে ‘গবেষণা’ চালাচ্ছেন, কী-করে সূর্যের ছায়াকে একটা কালো তাবুর ভেতর সাদা পর্দায় ফেলা যায়। এতে করে অনেক দর্শক মহা-দৃশ্যটা দেখতে পাবেন। পাশাপাশি কিছু পিন হোল ক্যামেরাও বানাতে চান ইরিনা। দরকারি সব যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে। সামি রাতেই সেসব দিয়ে অন্তত কালো তাবু বানিয়ে ফেলবেন। তাই সামি চলে গেছেন রামপুরায় ইমপেরিয়াল কলেজ ক্যাম্পাসে। ওখানেই শুক্রের চলন দেখার জন্য ‘মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ কমিটি’র প্রধান ক্যাম্প বসবে। কলেজের শিক্ষক সুমনা বিশ্বাসের কাছে আমরা ঋণী, তার সহযোগিতায় অনেক কিছুই সহজে সম্পন্ন করেছি আমরা।
আবার ফিরে যাই টিচার্স ট্রেণিং কলেজে। সেখানে চশমা বানানো চলছেই। বরিশাল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া- সারাদেশে অনেক চশমা লাগবে তো। ‘মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ কমিটি’ সহযোগী সংগঠনগুলোর বিজ্ঞানকর্মীরা অধীর আগ্রহে আর কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে চশমার জন্য। মহাজাগতিক দৃশ্য অবলোকনের জন্য। অন্তত সূর্যের মঞ্চে শুক্রের এমন চলন আগামী ১০৫ বছর আর একটিবারও দেখা যাবে না। পৃথিবীর কোথাও থেকে না। সুযোগ তাই হেলায় হারায় কে! তাই তাড়া ছিল বেশ। রাতের গাড়িতেই চশমা পাঠাতে হবে। কুষ্টিয়া থেকে রফিক বারবার ফোন করছেন। তার ইয়ুথ সায়েন্স গ্রুপের বিজ্ঞানকর্মীরা চশমা আদৌ পাবেন কি-না। রাত সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাসের হেলপারের কাছে চশমা তুলে দিতে না পারলে সব চেষ্টাই জলে যাবে। হাঁটুর ওপর মোবাইলে এক কান গুঁজে দিয়ে চশমা বানাতে বানাতে জাহাঙ্গীর বলছেন, ‘লুৎফর, হতাশ হইও না। রাখছি। পরে ফোন করছি।’ রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে লুৎফরের নেতৃত্বে বসবে আকিমুদ্দিন গ্রন্থাগারের এই ক্যাম্প। সংগঠনটি আরও কয়েকটি ক্যাম্প করছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে জমিনপুরে এবং ইকবালের তত্ত্বাবধানে রহনপুরে তাদের ক্যাম্প। আরেকটি ক্যাম্প বসবে ঢাকার উত্তরায়, সালুম হায়দারের নেতৃত্বে। এদিকে বরিশালে ক্যাম্প করছে বিজ্ঞান সংগঠন কসমিক কালচার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সপ্তর্ষি বিজ্ঞান ক্লাব এবং পাবনার বন্ধুসংঘ। উষার তত্ত্বাবধানে খুলনায় ডিসকাশন প্রজেক্টের আরেকটি ক্যাম্প বসছে।
সোয়া এগারোটা পর্যন্ত চলল চশমা বানানোর কাজ। এরপর যোয়েল ও জাহাঙ্গীর বাসে উঠে পড়লেন। কল্যাণপুর বাস কাউন্টারে। সব জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন চশমা। রাতে তখন বাসায় ফেরার সুযোগ ছিল না জাহাঙ্গীরের। তাছাড়া ঢাকার জন্য তো কোন চশমা বানানো হয়নি! তাই দুজনার গন্তব্য মিরপুরে যোয়েলের বাসায়। রাত সোয়া একটায় বাসায় পৌঁছে রান্না-খাওয়া। এই বিরতি ছাড়া ভোর চারটা পর্যন্ত চশমা বানালেন তারা। ইতোমধ্যে ইরিনা চলে গেছেন মূল ক্যাম্পে। জাহাঙ্গীর আর যোয়েল চশমা নিয়ে ইমপেরিয়াল ক্যাম্পে পৌঁছলেন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে। অনেকে দর্শক জড় হয়েছেন। খালেদা ইয়াসমিন ইতির সঙ্গে তার শিশু পুত্র বিজ্ঞানকর্মী অরণ্যও চলে এসেছে ক্যাম্পে। কিন্তু তখনো সূর্য পুরো মেঘে ঢাকা। কড়া কিরণ না থাকলে ইরিনার কালো তাবুর সাদা পর্দা কোন কাজে আসবে না। শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছিল। সূর্য উঠছে না দেখে নিস্ফল না হয়ে আমরা কলেজের একটা কক্ষে ভিডিওচিত্র প্রদর্শনী, আসিফের বক্তৃতা, প্রশ্নোত্তর- ইত্যাদি চালিয়ে গেলাম। এর মধ্যে আমাদের কাছে প্রথম ফোন এলো রহনপুর থেকে। ইকবালের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, ‘দারুণ। আমরা দেখছি। ভীষণ ভালো লাগছে। এখানে সবাই তো পাগল হয়ে যাচ্ছে।’ কিছুক্ষণ বাদেই ফোন এলো রাজশাহীর পদ্মার পাড় থেকে, ‘যারা রাতে পাগল বলছিল, তারাই এসে চশমা চেয়ে সূর্য দেখছে। ওই কালো তিলটা দেখছি। আজীবন মনে থাকবে।’ এভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে একে একে ফোন করে তাদের আবেগ-অনুভূতি জানাচ্ছিল। আমরা ঢাকায় শুক্র চলন দেখতে পেলাম পৌনে নয়টার দিকে। এরপর আবার মেঘের আড়ালে সূর্যের লুকোচুরি শুরু হলো। তার মধ্য দিয়েই চশমায় চোখ রেখে আমরা দেখতে থাকলাম অনিন্দ্যসুন্দর সেই দৃশ্য যা দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ হয়তো আমাদের কখনোই হবে না।
মহাজাগতিক ঘটনা পর্যবেক্ষণ কমিটি মনে করে, এ ধরনের পর্যবেক্ষণে মহাবিশ্ব, সৌরজগৎ ও প্রাণের উদ্ভব সম্পর্কে মানুষের মনে আগ্রহ গড়ে ওঠে। তৈরি হয় এক ধরনের সাংস্কৃতিক বোধ। এসব অনিন্দ্যসুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে কুসংস্কারমুক্ত একটি সমাজ। হয়তো এই পথ ধরে ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্ম জ্যোতির্বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে রাধা-গোবিন্দ, চন্দ্রশেখর কিংবা মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞানীদের পথ ধরে। যেকোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই কর্মকান্ডের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে একে শক্তিশালী করতে পারেন। এর মধ্য দিয়েই হয়তো শুরু হবে আগামী প্রজন্মের জন্য মানমন্দির তৈরির প্রচেষ্টা যা মহাকাশের দিকে নক্ষত্রের দিকে তাকানোর প্রতীক হয়ে দেখা দেবে তরুণ প্রজন্মের কাছে।