এক মহাজাগতিক অভিযাত্রা
- ১৯:০৩
- ৩০৪৬
২০০৩ সালের ঘটনা। ৬০ হাজার বছরের ব্যবধানে মঙ্গল গ্রহ তখন পৃথিবীর সাথে নিকটতম অবস্থানে এসেছে। সারা বিশ্বের মানুষ উৎসুক হয়ে রয়েছে ‘মঙ্গল’ বরণ নিয়ে, পিছিয়ে ছিল না বাংলাদেশও। শৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন এর উদ্যোগে দেশব্যাপি আয়োজন করা হয় ‘মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প’। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য লালিত প্রাচীণ নগরী বরিশালে ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৩ বসেছিল মঙ্গলের হাট। আগে থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমে আয়োজন সম্পর্কে প্রচারের কারণে সেদিন সন্ধ্যা থেকেই কয়েক হাজার মানুষের ভীড় উপচে পড়েছিল নগরীর অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। টেলিস্কোপে অনেক রাত পর্যন্ত মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণে হাজারো ঔৎসুক মানুষের জমায়েত ছিল বরিশালের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। মঙ্গল যেন সেদিন খুলে দিয়েছিল বিজ্ঞানচর্চার জানালাটাকে।
বরিশালের এই আয়োজনে সার্বিকভাবে যুক্ত ছিল এসোসিয়েশনের বরিশাল প্রতিনিধিসহ প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরা বিজ্ঞানমনস্ক কিছু তরুণ। তারা অবাক বিস্ময়ে সেদিন উপলব্দি করেছিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় পরিমন্ডলের বাইরে সাধারণ মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আকাঙ্খা রয়েছে, যা এই তরুণ কর্মীদের মাঝে নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। বিজ্ঞানচর্চাও হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতির একটি অংশ। এই বোধ থেকেই বিজ্ঞানচর্চাকে ছড়িয়ে দিতে সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে গঠিত হয় ‘কসমিক কালচার’। ২০০৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর কসমিক কালচারের যাত্রা শুরু।
বিজ্ঞান সংগঠন মানে এই নয় শুধুমাত্র মেলায় বিজ্ঞান মেলায় প্রজেক্ট প্রদর্শনী করা। বরং কসমিক কালচার চেয়েছে ভিন্ন কিছু। স্বপ্ন দেখেছে মেধা ও যুক্তির চর্চায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মকে নিয়ে সৃজনশীল ভবিষ্যত গড়ার। কারণ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত ধারণার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নের চেতনা ও ধারণা বিকশিত করা যত সহজ ও বাস্তবসম্মতভাবে সম্ভব, তা আর কোনভাবেই সম্ভব নয়। মানুষকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের পশ্চাদমুখিতাকে শনাক্ত করিয়ে দিতে পারলে নিজে থেকেই তার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞানঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠবে। এই অবস্থান ও বিবেচনা থেকেই ‘কসমিক কালচার’ সক্রিয় ও তৎপর।
কয়েকজন তরুণের নিরন্তর প্রচেষ্টার পাশাপাশি কসমিক কালচারের সাংগঠনিক রূপ দেওয়া থেকে শুরু করে সবসময়েই প্রেরণা জুগিয়ে পাশে থেকেছেন প্রিয় শিক্ষক - ড. অনীশ মণ্ডল ও বিকাশ ভূষণ মণ্ডল। তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায় ভরপুর এই দু’জন তাদের মেধা ও শ্রমে স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছেন বরাবর। ধীরে ধীরে এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক নাম ….. প্রাণোচ্ছ্লতায় ভরা আরও কিছু উদ্যোগী ও উদ্যোমী মানুষ।
একটি সফল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতার। বাংলাদেশে কনসার্ট বা উৎসবের জন্য খুব সহজেই পৃষ্ঠপোষক পাওয়া গেলেও বিজ্ঞান আয়োজনের ক্ষেত্রে তেমনটি পাওয়া দুষ্কর। আর বরিশালের প্রেক্ষাপটে এটি চিন্তা করাও যেন বারণ। একবারের ঘটনা, চাঁদে মানুষের অবতরণের (২১ জুলাই ১৯৬৯, অ্যাপোলো-১১ অভিযান) ৩৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একটি বিজ্ঞান আলোচনা এবং চন্দ্রাভিযানের ওপর পোস্টার ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর। এজন্য ঢাকা থেকে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল এসোসিয়েশন এর সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় উপকরণ বরিশালে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর যোগাড় করা নিয়ে। কারণ সে সময় বরিশালে কোন মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ভাড়া পাওয়া যেত না। অনেক দেন-দরবারের পর তথ্য অধিদপ্তর থেকে একটি মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহারের জন্য দিলেও নতুন এক বিপত্তি উপস্থিত। অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য বিনামূল্যে যে হলরুমটি পাওয়ার কথা ছিল সেটি নির্ধারিত দিনে হঠাৎ করেই বাতিল হয়ে যায়। এদিকে প্রস্তুতিতে বাজেটের পুরোটাই খরচ হয়ে যাওয়ায় সেই মুহুর্তে টাকা যোগাড় করে নতুনভাবে হলরুম ভাড়া করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। বিকল্প কোন উপায়ও ছিল না পরিস্থিতি মোকাবেলার। ফলে নিতান্ত বাধ্য হয়েই ভারাক্রান্ত মনে বাতিল করে দিতে হয় সমস্ত আয়োজন। শুরুর দিকে সময়মতো টাকার অভাবে অনেক আয়োজন যথাযথভাবে আয়োজন করা সম্ভব না হলেও পরবর্তীতে সংগঠনের অধিকাংশ কার্যক্রমের ব্যয় কারও মুখাপেক্ষা না করেই হাসি মুখে বহন করেছে সদস্যরাই। “ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” প্রবাদটির সার্থকতা কসমিক কালচারের সদস্যদের নিজেদের তাগিদ আর সদিচ্ছার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় এখনো।
আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার সন্ধানে উন্নত বিশ্ব যখন অগ্রসরমান, তখন আমরা পশ্চাৎপদতা আর গতানুগতিকতার আটপৌঢ়ে চিন্তায় আবর্তিত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রযুক্তির নানাবিধ ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠলেও চিন্তায় ও মননে বিজ্ঞানমনস্কতা অনেকাংশেই তৈরি হয়নি। এই অনগ্রসরতার দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার দুঃসাহস নিয়ে কসমিক কালচার স্বপ্ন দেখে আজ থেকে ২৬শত বছর পূর্বে ঈজিয়ান সাগরের পূর্বাঞ্চলে গড়ে ওঠা আয়োনীয় সভ্যতার কিংবা ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী আলেক্সান্দ্রিয়া নগরীর পুনরাবৃত্তির, যেখানে মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চায় আর যৌক্তিক চিন্তায় বেড়ে উঠবে আগামী প্রজন্ম। যে ছাড়িয়ে যাবে নিজেকে, ছাড়িয়ে যাবে বর্তমানকে…..হয়ে উঠবে মহাজাগতিক পথিক। মানবিক স্বপ্নে বিভোর আমরা সেই ভবিষ্যত বিজ্ঞান রেণেঁসার জন্য প্রতীক্ষিত।
যারা আমাদের কাজে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা নিয়ে পাশে থেকেছেন সকলের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ভবিষ্যত কার্যক্রম পরিচালনায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা আরও বেশি কামনা করছি। বিজ্ঞানমনস্ক ও বিজ্ঞানঘনিষ্ঠ ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ার এই কার্যক্রমে তাই আপনাকে একান্তভাবে আমন্ত্রণ!